কথা যেভাবে দোয়া হয়ে যায়

 


জীবনে পথচলায় আমরা নানা কথা বলে থাকি। ভালো-মন্দ, সাধারণ-অসাধারণ—সব ধরনের কথাই উচ্চারিত হয় আমাদের মুখ থেকে। কিন্তু আমরা যদি দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কথাগুলোয় অল্প কিছু শব্দ যোগ করি, তবে তা আমাদের জন্য পরম সওয়াবের মাধ্যম হতে পারে।


এতে কথার সৌন্দর্য বাড়ে এবং সওয়াবের খাতায় আমাদের জন্য নেকি জমা হয়, ইনশা আল্লাহ। এ কথাগুলো শুধু কথাই থাকে না; বরং দোয়া ও ইবাদতে রূপান্তরিত হয়।


নিচে সময় ও পরিস্থিতি অনুসারে কিছু শব্দ বা বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে কীভাবে আমরা প্রিয় নবীজি (সা.)–এর সুন্নাহ আদায় করতে পারি এবং কথাগুলোকে সওয়াবের মাধ্যমে পরিণত করতে পারি, তার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো—


১. কাজ শুরু করার সময়: বিসমিল্লাহ


কোনো কাজ শুরু করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ (আল্লাহর নামে শুরু করছি) বলা সুন্নাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৩৭৬)


আল্লাহর নামে কাজ শুরু করলে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার আশা থাকে এবং কাজের সময়টি ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।


খাওয়া, পান করা, লেখা, পড়া বা যেকোনো কাজ শুরু করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ না বললে কাজে বরকত পাওয়া যায় না এবং শয়তান তাতে অংশ নেয়।


২. খাওয়াদাওয়া শেষে: আলহামদুলিল্লাহ


কিছু খাওয়া বা পান করা শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ (সব প্রশংসা আল্লাহর) বলা উচিত। এ ছাড়া কোনো শুভ সংবাদ শুনলেও এ বাক্য বলা উত্তম। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৭৩৪)


৩. সাক্ষাতের সময়: আসসালামু আলাইকুম


কারও সঙ্গে দেখা হলে ‘হাই’ বা ‘হ্যালো’র পরিবর্তে ‘আসসালামু আলাইকুম’ (আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) বলা উচিত। (সুরা আন-নুর, আয়াত: ৬১)


পরিচিত বা অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার জন্য কোরআন ও হাদিসে নির্দেশনা রয়েছে।


কোনো অমুসলিম সালাম দিলে শুধু ‘ওয়া আলা৪. কুশল জিজ্ঞাসায়: আলহামদুলিল্লাহ


কেউ ‘কেমন আছেন’ বলে কুশল জিজ্ঞাসা করলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উত্তম। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩,৮০৫)


এটি একটি জিকির, সদকা ও উত্তম দোয়া। সুখে-দুঃখে, সচ্ছল বা অসচ্ছল—সব অবস্থায় শুকরিয়া আদায়কারীই আল্লাহর প্রকৃত কৃতজ্ঞ বান্দা।


৫. অসুস্থতা বা অস্বস্তিতে: আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল


শারীরিক বা মানসিকভাবে ভালো না থাকলে ‘ভালো লাগছে না’ বলার পরিবর্তে ‘আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল’ (যেকোনো অবস্থাতেই আল্লাহর প্রশংসা) বলা উচিত। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৮০৪)


রাসুল (সা.) অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে এ বাক্য বলতেন।


৬. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব দেখলে: আল্লাহু আকবার


আল্লাহর মহত্ত্ব বা শ্রেষ্ঠত্বের কোনো নিদর্শন দেখলে বা শুনলে ‘সুপার’ বা ‘অসাম’ না বলে ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ মহান) বলা সুন্নাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২১৮)


৭. বিস্ময় প্রকাশে: সুবহানআল্লাহ


আশ্চর্যজনক কিছু দেখলে বা শুনলে ‘ওয়াও’ না বলে ‘সুবহানআল্লাহ’ (আল্লাহ পবিত্র-মহান) বলতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২১৮)


এটি একটি জিকির ও সদকা, যা সওয়াব বৃদ্ধি করে।


৮. পছন্দনীয় কিছু দেখলে: মাশা আল্লাহ


কোনো কিছু পছন্দ হলে ‘জোশ’ না বলে ‘মাশা আল্লাহ’ (আল্লাহ যেমন চেয়েছেন) বলা সুন্নাহ। এটি নিজেকে বা অন্যকে বদনজর থেকে রক্ষার মাধ্যম। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩,৫০৮)


৯. ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়: ইনশা আল্লাহ


ভবিষ্যতে কোনো কাজ বা কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ‘ইনশা আল্লাহ’ (আল্লাহ ইচ্ছা করলে) বলতে হবে। (সুরা কাহাফ, আয়াত: ২৩-২৪)


১০. হাঁচির সময়: আলহামদুলিল্লাহ ও ইয়ারহামুকাল্লাহ


কেউ হাঁচি দিলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা সুন্নাহ। আর তা শুনলে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন) বলা উচিত। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২২৪)


১১. অপ্রীতিকর কিছু দেখলে: নাউযুবিল্লাহ


কোনো বাজে কথা শুনলে বা গুনাহর কিছু দেখলে ‘শিট’ না বলে ‘নাউযুবিল্লাহ’ (আমরা এ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই) বলতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৩৬২)


১২. বিপদ বা অশুভ সংবাদে: ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন


কোনো বিপদের কথা বা অশুভ সংবাদ শুনলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব) বলতে হবে। (সুরা বাকারা১৩. ভুল বা গুনাহে: আস্তাগফিরুল্লাহ


ভুলবশত গুনাহ করে ফেললে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই) বলতে হবে। (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১৯; সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৩০৭)


রাসুল (সা.) প্রতিদিন ৭০ বারের বেশি ইস্তিগফার করতেন।


১৪. ওপরে ওঠা বা নামার সময়: আল্লাহু আকবার ও সুবহানআল্লাহ


ওপরে ওঠার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ ও নিচে নামার সময় ‘সুবহানআল্লাহ’ বলা সুন্নাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৯৯৩)


১৫. অনিশ্চিত বিষয়ে: আল্লাহু আলাম


নিশ্চিত না জেনে কিছু বললে কথার শেষে ‘আল্লাহু আলাম’ (আল্লাহই ভালো জানেন) বলা সুন্নাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৫৭০)


১৬. সমস্যার সম্মুখীন হলে: তাওয়াক্কালতু ‘আলাল্লাহ্‌


কোনো সমস্যা দেখা দিলে ‘তাওয়াক্কালতু ‘আলাল্লাহ্‌ (আল্লাহর ওপরই ভরসা) বলতে হবে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৪০৬)


১৭. আনন্দের মুহূর্তে: ফা তাবারাকাল্লাহ


আনন্দদায়ক কিছু ঘটলে ‘ফা তাবারাকাল্লাহ’ (আল্লাহর বরকত) বলা উচিত। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৩৭৫)


১৮. ভয়ের মুহূর্তে: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ


ভয় পেলে চিৎকার না করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই) বলতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৩৪৬)


১৯. কৃতজ্ঞতা প্রকাশে: জাযাকাল্লাহু খাইর


কেউ ভালো কিছু দিলে বা উপকৃত করলে ‘থ্যাংকস’ না বলে ‘জাজাকাল্লাহু খাইর’ (ছেলেদের জন্য) বা ‘জাজাকিল্লাহু খাইরান’ (মেয়েদের জন্য) বলা সুন্নাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩৬)


এটি একটি উত্তম দোয়া, যা শুধু কথা নয়; বরং উপকারীর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা।


২০. সফলতার জন্য: ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ


কোনো কাজে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে ‘ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ’ (আমার সফলতা কেবল আল্লাহর মাধ্যমে) বলা উত্তম। (সুরা হুদ, আয়াত: ৮৮)


২১. শুভকামনায়: বারাকাল্লাহু ফিক


কারও ভালো কিছু দেখলে বা শুভকামনা জানাতে ‘মাশা আল্লাহ’ এর সঙ্গে ‘বারাকাল্লাহু ফিক’ (পুরুষের জন্য) বা ‘বারাকাল্লাহু ফিকি’ (নারীর জন্য) বলা উত্তম। এটি বদনজর থেকে রক্ষা করে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৩২)


২২. বিজয়ের সময়: আল্লাহু আকবার


কোনো বিজয় লাভ করলে বা বিজয়ের আশায় ‘আল্লাহু আকবার’ বলা সুন্নাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১০)


২৩. বিদায়ের সময়: ফি আমানিল্লাহ


বিদায় নেওয়ার সময় ‘বাই’ বা ‘টেক কেয়ার’ না বলে ‘ফি আমানিল্লাহ’ (আল্লাহ নিরাপত্তা দিন) বলা উচিত। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৪৪০)


ইসলামে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার চেয়ে চুপ থাকা উত্তম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০২), আয়াত: ১৫৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,১২৬)ইকুম’ বলে জবাব দিতে হবে।

Countdown Timer

Post a Comment

Previous Post Next Post