মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার ওঠানামা এক প্রকার স্বাভাবিক বিষয়। তবে কখনো কখনো এই দুঃখ-চিন্তা অতিরিক্ত রূপ ধারণ করে মানুষকে এক জটিল মানসিক অবস্থায় ঠেলে দেয়। আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় এর দুটি বড় দিক হলো দুশ্চিন্তা (Anxiety/Worry) ও ডিপ্রেশন (Depression)। এরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও সম্পূর্ণ একই নয়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। কারণ মানসিক শান্তি ও প্রশান্তি ইসলামের অন্যতম উদ্দেশ্য।
দুশ্চিন্তা হলো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়, উত্কণ্ঠা বা অস্থিরতা। এর লক্ষণগুলো হচ্ছে অজানা ভয় বা আশঙ্কায় বিচলিত হওয়া, ঘুম না আসা, সামান্য সমস্যাকে বিশাল আকারে দেখা, বুক ধড়ফড় করা, ঘাম হওয়া বা কাঁপুনি ইত্যাদিদুশ্চিন্তা যদি সামান্য হয়, তবে তা মানুষকে সচেতন ও কর্মতত্পর হতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন তা অতিরিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তা রোগে পরিণত হয়, যাকে Anxiety Disorder বলা হয়। আর ডিপ্রেশন হলো মানসিক অবসাদ, হতাশা ও জীবনের প্রতি আগ্রহ হারানো। এর লক্ষণগুলো হচ্ছে সবকিছুর প্রতি অনাগ্রহ, আনন্দের অভাব, অতীত নিয়ে আফসোস, ভবিষ্যত্ নিয়ে হতাশা, ক্ষুধা ও ঘুমের ব্যাঘাত, আত্মহননের চিন্তা, নিজেকে মূল্যহীন মনে হওয়া ইত্যাদি। ডিপ্রেশন দুশ্চিন্তার তুলনায় অনেক গভীর মানসিক অসুখ, যা চিকিত্সা ছাড়া দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে।
ডিপ্রেশন আর দুশ্চিন্তার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- দুশ্চিন্তায় ভবিষ্যৎ নিয়ে উত্কণ্ঠা তৈরি হয়। ডিপ্রেশনে বর্তমান ও অতীত নিয়ে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়। তবে অনেক সময় দুশ্চিন্তা ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আবার ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যেও প্রবল দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারেডিপ্রেশন ও দুশ্চিন্তার কারণসমূহ
অতিরিক্ত বস্তুবাদী জীবনধারা ও প্রতিযোগিতা, পারিবারিক অশানি্ত ও সামাজিক চাপ, আর্থিক অনিশ্চয়তা, মানসিক আঘাত বা ব্যর্থতা, আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ভরসার ঘাটতি।
ইসলামের দৃষ্টিতে দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন ইসলাম মানুষকে মানসিক প্রশানি্ত ও অন্তরের শান্তির পথে পরিচালিত করে। কোরআন ও হাদিসে বারবার বলা হয়েছে, আল্লাহর স্মরণে ও ভরসায় অন্তর শান্ত হয়।
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর শান্ত হয়, জেনে রাখো আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।' (সুরা রাদ, আয়াত: ২৮)
অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, কোনো বিপদ আসে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া, আর যে আল্লাহর উপর ঈমান রাখে, তিনি তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।' (সুরা আত-তাগাবুন, আয়াত : ১১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) দুশ্চিন্তা ও মানসিক অশানি্ত দূর করার জন্য বিশেষ দোয়া শিখিয়েছেন, আল্লা-হুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি, ওয়াল আজজি ওয়াল কাসালি, ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া দালাইদ দ্বাইনে ওয়া গালাবাতির অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও কাপুরুষতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষের অত্যাচার থেকে।' (বুখারি, হাদিস : ৫৪২৫)
দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন প্রতিকারের উপায়
তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা): জীবনের সব বিষয়ই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। যখন মানুষ হূদয়গভীরভাবে এ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করে যে কোনো কিছু আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ঘটে না, তখন তার মনের মধ্যে গভীর প্রশানি্ত আসে। যে ব্যক্তি প্রতিটি পরিস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে, সে হতাশা ও অস্থিরতার সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তাদের জন্য যথষ্টে।' (সুরা আত-তালাক, আয়াত নামাজ ও দোয়া : নামাজ অন্তরের প্রশানি্ত ও আত্মার শানি্তর অন্যতম মাধ্যম। নিয়মিত নামাজে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, চিন্তাভাবনাকে আল্লাহর স্মরণে কেন্দ্রীভূত করা যায়। একইভাবে দোয়া হলো অন্তরের আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন, যা মানসিক চাপ কমাতে বিশেষ কার্যকর। হাদিসের ভাষ্য মতে- যে ব্যক্তি দুশ্চিন্তা ও কষ্টে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার অন্তরে আলো ঢেলে দেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৪২৫)
কোরআন তিলাওয়াত : কোরআনের শব্দ ও অর্থের গভীরতা মনকে প্রশান্ত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোরআন তিলাওয়াতের ধ্বনি মানসিক চাপ কমায় এবং হৃদয়কে স্থিতিশীল রাখে। মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, আল্লাহর স্মরণে অন্তর শানি্ত পায়।' (সুরা রাদ, আয়াত : ২সদকা ও সত্কর্ম : দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সত্কর্ম ও সদকারও আলাদা ভূমিকা আছে। এটি কেবল অন্যকে উপকার করে না, বরং মানুষের অন্তরেও আনন্দ ও পরিতৃপ্তি আনে। কোরআনের ভাষ্য মতে, যারা অর্থ ও সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, আল্লাহ তা বৃদ্ধি দেন এবং তাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।' এতে স্পষ্ট হয় যে সদকা ও নেককর্ম মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রশানি্ত আনে, দুশ্চিন্তা হ্রাস করে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো দুশ্চিন্তা বা বিপদে ভোগে, সে যদি আল্লাহর পথে কিছু সদকা করে, আল্লাহ তা তার জন্য লাঘব করে দেন।' (তিরমিজি, হাদিস : ৬১৬; ইবন মাজাহ, হাদিস : ১৮২৫)
সদকা শুধু দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি অর্থ, সময়, ক্ষমতা, বা ভালো আমলের যেকোনো কিছু প্রয়োগ করেই হতে পাসুস্থ জীবনযাপন : মানসিক সুস্থতার জন্য শারীরিক সুস্থতাও অপরিহার্য। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার ও পর্যাপ্ত ঘুম শরীর ও মনকে শক্তিশালী করে। আল্লাহর বিধান অনুসারে সুষম জীবনযাপন মানুষকে মানসিক চাপ ও অবসাদ থেকে দূরে রাখে।
সুসম্পর্ক বজায় রাখা : পরিবার, বন্ধু এবং মুমিন ভাই-বোনদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ভালো সম্পর্ক অন্তরে নিরাপত্তা ও আশ্বাসের অনুভূতি জাগিয়ে দেয়। ইসলামে পারস্পরিক সাহায্য, দোয়া এবং পরস্পরের জন্য শুভকামনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন মানুষ এমন ইতিবাচক পরিবেশে থাকে, দুশ্চিন্তা ও হতাশার প্রকোপ কমে যায়।
দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন আজকের যুগের এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। আধুনিক চিকিত্সা যেমন এর প্রতিকার দেয়, তেমনি ইসলামী শিক্ষা এর মূল ভিত্তিতে শানি্ত স্থাপন করে। যে অন্তর আল্লাহর উপর ভরসা করে, সে কখনো হতাশ হয় না। আল্লাহ বলেন, তোমরা হতাশ হয়ো না, নিরাশ হয়ো না। যদি তোমরা ঈমানদার হও তবে তোমরাই শ্রেষ্ঠ।' (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৯)
মহান আল্লার কাছে প্রার্থনা তিনি যেনো আমাদের সকলের অন্তরকে প্রশান্ত আমাদেরকে দুশ্চিন্তা ও হতাশার চক্র থেকে মুক্তি দান করেন। আমাদের মন ও হৃদয়কে তারই প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং শান্তিময় করেন। আমিন
Post a Comment