হার্টের অসুখ বা হৃদরোগকে একসময় শুধু মধ্যবয়সী বা প্রবীণদের রোগ হিসেবে দেখা হতো। সাধারণ ধারণা ছিল, বয়স বাড়লেই হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই হার্ট অ্যাটাক বা অন্যান্য হৃদরোগ দেখা দেয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মও কম বয়সেই হার্টের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, একজন তরুণ যদি ত্রিশ বা পঁইত্রিশ বছর বয়সেই হার্টের সমস্যায় ভোগেন, তাহলে তার সামনে থাকা দীর্ঘ জীবনের পথটি নানা জটিলতায় ভরে যায়। শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, পরিবার এবং সমাজও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।হার্টের অসুখ তরুণদের মধ্যে কেন বাড়ছে, তার অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমেই আসে জীবনযাত্রার ধরণ। আজকের তরুণরা আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি ব্যস্ত, প্রতিযোগিতার চাপও অনেক বেশি। পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা কিংবা ক্যারিয়ারের চিন্তায় তারা নিয়মিত দুশ্চিন্তায় ভোগেন। মানসিক চাপের এই বোঝা ধীরে ধীরে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে হৃদযন্ত্রে। পাশাপাশি শরীরচর্চার অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাবার, তেল-চর্বি বেশি খাওয়া, ফাস্টফুডের প্রতি আকর্ষণ— সবকিছুই মিলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাচ্ছে।ধূমপান এবং মাদকও তরুণদের হৃদযন্ত্রের বড় শত্রু। অনেকে বন্ধুবান্ধবের চাপে বা আধুনিকতার মোহে ধূমপান শুরু করে এবং পরবর্তীতে সেটি অভ্যাসে পরিণত হয়। ধূমপানের ক্ষতি ধীরে ধীরে জমে শরীরে নানা রোগের জন্ম দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে রক্তনালিতে। ধূমপান রক্তনালিকে সরু করে, রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। একইভাবে মাদকও শরীরের জন্য ভয়াবহ, যা শুধু মস্তিষ্ক নয়, হৃদযন্ত্রকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রযুক্তির যুগে তরুণদের জীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। অনেকে দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা মোবাইলের সামনে বসে থাকে, পর্যাপ্ত নড়াচড়া করে না। একসময় খেলাধুলা ছিল তরুণদের দৈনন্দিন জীবনের বড় অংশ, কিন্তু এখন সেটা ক্রমেই কমছে। এতে শরীরে চর্বি জমে, ওজন বেড়ে যায়, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি হয়। এগুলোই পরবর্তীতে হার্টের অসুখ ডেকে আনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণদের মধ্যে রাতজাগা এবং পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার প্রবণতাও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। অনেকে কাজের চাপে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটিয়ে রাত গভীর পর্যন্ত জেগে থাকে। ফলে শরীর ও মন বিশ্রাম পায় না। ঘুমের ঘাটতি থেকে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থা চলতে থাকলে হৃদরোগ দেখা অন্যদিকে, মানসিক চাপ বা স্ট্রেসও হার্টের জন্য সমান ক্ষতিকর। যারা নিয়মিত মানসিক চাপের মধ্যে থাকে, তাদের শরীরে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে হৃদযন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। কর্মজীবী তরুণরা প্রতিদিন নানা প্রতিযোগিতা, চাকরির অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে দুশ্চিন্তায় থাকে। এই দুশ্চিন্তাই ধীরে ধীরে তাদের হৃদযন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব কি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়। নিয়মিত শরীরচর্চা, সুষম খাবার খাওয়া, ধূমপান ও মাদক থেকে দূরে থাকা, পর্যাপ্ত ঘুম, এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা—এসব অভ্যাস গড়ে তুললে হৃদযন্ত্রকে অনেকটা সুস্থ রাখা যায়। পাশাপাশি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোও জরুরি, কারণ অনেক সময় হার্টের সমস্যার উপসর্গ স্পষ্ট হয় না। আগে থেকে রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ হয় এবং ঝুঁকি কমে যায়।
তরুণ বয়সে হার্টের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সমাজের জন্যও একটি বড় দুশ্চিন্তা। তরুণরাই একটি দেশের সবচেয়ে কর্মক্ষম অংশ। যদি তারা সুস্থ না থাকে, তবে দেশের উন্নয়নও ব্যাহত হয়। তাই শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতা নয়, পরিবার ও সমাজকেও তরুণদের স্বাস্থ্য বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি, গণমাধ্যমে প্রচারণা— এসব উদ্যোগ তরুণদের হৃদযন্ত্রকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।
হার্টের অসুখ এখন আর শুধু বয়সীদের সমস্যা নয়, তরুণদের মধ্যেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এটি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে, তবে একই সঙ্গে সচেতনতার মাধ্যমেই এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। সুস্থ জীবনযাপন, সঠিক অভ্যাস এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শই পারে তরুণ প্রজন্মকে হৃদরোগ থেকে রক্ষা করতে। জীবন এখন যতই ব্যস্ত বা প্রতিযোগিতামূলক হোক না কেন, হৃদয়ের যত্ন নেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি সুস্থ হৃদয় মানেই একটি সুস্থ জীবন।দেয়।
Post a Comment