মানসিক চাপ মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে!

 


মানুষের জীবনে মানসিক চাপ এমন এক বিষয় যা এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। কর্মব্যস্ত জীবন, পারিবারিক টানাপোড়েন, আর্থিক অনিশ্চয়তা কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের সংকট—সব মিলিয়ে চাপ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। অল্পমাত্রার চাপ কখনও কখনও মানুষকে কাজে মনোযোগী করে তুলতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে বা অতিরিক্ত মানসিক চাপ মস্তিষ্কের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া এখন এক গুরুতর সমস্যায় পরিণত হচ্ছে।বিজ্ঞানীরা বলছেন, যখন মানুষ মানসিক চাপে থাকে, তখন শরীর থেকে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসৃত হয়। এর মধ্যে কর্টিসল নামের একটি হরমোন মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই হরমোন বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হলে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। হিপোক্যাম্পাস হলো সেই অংশ যা স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর ক্ষতি হলে নতুন তথ্য মনে রাখা কঠিন হয়ে যায়, পুরোনো স্মৃতিও ঝাপসা হতে থাকে।অতিরিক্ত চাপের কারণে মানুষ প্রায়ই মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এক কাজের মধ্যে মনোযোগ হারিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। ছোটখাটো বিষয়ও মনে রাখতে কষ্ট হয়। যেমন—কারও নাম মনে না পড়া, দরকারি জিনিস কোথায় রেখেছি তা ভুলে যাওয়া, বা প্রতিদিনের সাধারণ কাজ ভুলে যাওয়া। ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলো বেড়ে গেলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, পেশাগত জীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একজন কর্মী যদি সবসময় চাপের মধ্যে থাকেন, তাহলে তার উৎপাদনশীলতা কমে যায়, সৃজনশীলতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


মানসিক চাপ মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের উপরও সরাসরি প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় ধরে চাপের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে কোষের সংযোগ দুর্বল হয়ে যায়। ফলে নতুন তথ্য প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা কমে যায়। আবার ঘুমের ব্যাঘাতও ঘটে, যা স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার আরেকটি বড় কারণ। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্কে তথ্য সাজানো ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে ঘুমের ঘাটতি ও মানসিক চাপ একসঙ্গে মিলে মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর চক্র তৈরি করে।


আজকের দিনে মানসিক চাপ শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের নয়, শিশু ও কিশোরদের মাঝেও দেখা যাচ্ছে। পড়াশোনার চাপ, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার চেষ্টা, কিংবা প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ফলে কম বয়সেই অনেক শিশু মনোযোগের ঘাটতি ও ভুলে যাওয়ার সমস্যায় ভুগছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে ভবিষ্যতে আরও গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হতে পাতবে সুখবর হলো, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিয়মিত ব্যায়াম, মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং নিজের পছন্দের কাজে সময় দেওয়া চাপ কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, প্রকৃতির কাছে যাওয়া কিংবা আড্ডায় মেতে ওঠা মানসিক প্রশান্তি আনে। যখন মন ভালো থাকে, তখন মস্তিষ্কও ভালোভাবে কাজ করে। এতে স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে উন্নত হয়।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চাপকে একেবারেই উপেক্ষা না করা। অনেকেই মনে করেন চাপ সাময়িক, তাই গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু বাস্তবে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনেক ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাই প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সতর্ক হওয়া জরুরি। যখনই মনে হয় ছোটখাটো বিষয়ও মনে রাখতে কষ্ট হচ্ছে বা কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি, তখনই চাপ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া উচিত।


মানসিক চাপ শুধু মনকে ভারী করে তোলে না, বরং মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আধুনিক জীবনের প্রতিযোগিতা ও ব্যস্ততার ভিড়ে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন, কিন্তু সঠিক জীবনযাপন ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এর প্রভাব অনেকটাই কমানো যায়। সুস্থ মন এবং চাপমুক্ত জীবনই পারে আমাদের মস্তিষ্ককে সতেজ ও স্মৃতিশক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী রাখতে।রে।

Countdown Timer

Post a Comment

Previous Post Next Post